"জীবনে দুটো জিনিস খুবই কষ্টদায়ক।

-->
"জীবনে দুটো জিনিস খুবই কষ্টদায়ক

একটি হচ্ছে, যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমাকে ভালোবাসে কিন্তু তা তোমাকে বলে না

আর অপরটি হচ্ছে, যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমাকে ভালোবাসে না এবং সেটা তোমাকে সরাসরি বলে দেয়।" :(
...

-
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
 
 
মেঘে মেঘে
by Amran Hossain Patwary

রাতের আকাশে নবমীর চাঁদ এবং জল ভারাক্রান্ত মেঘের মধ্যে খেলা চলছেমেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাদটা ক্ষণিকের জন্য উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যাচ্ছে ঘন মেঘের আড়ালেনিঃস্তব্ধ রাতের পরিবেশআকাশে ঘন মেঘ জমেছেছাদের কার্ণিশে বসে রাশেদ মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখছেওর আজ মন ভাল নেইমন ভাল থাকলে সে গুনগুনিয়ে গান ধরতগানের বদলে এখন ওর বুক থেকে অব্যক্ত কান্না বেরিয়ে আসছেঅভিমানী শিশুর কান্নার মত ওর চোখ-মুখে কান্না ফুটে উঠছে

কিশোর রাশেদষোল পেরিয়ে সতেরোতে পা দিয়েছে কেবলএই স্বল্প সময়ে অনেক কান্না জমেছে বুকের মধ্যেজীবনটাকে ওর একটি বাস্তব গল্প মনে হচ্ছেসেই গল্পের নায়ক স্বয়ং রাশেদনিজেকে ওর এখন এক লক্ষহীন সৈনিক মনে হচ্ছেদশ বছর আগে যখন সে পিতৃহারা হয়, তখন পিতার মর্ম সে জানত নাসেদিন সকলে যখন বাবার দাফন নিয়ে ব্যস্ত, তখন সে মনের আনন্দে বন্ধুদের সাথে খেলেছেতারপর একটি একটি করে কেটে গেছে অনেকগুলো দিনস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ওঠার পর আজ পিতার অভাবটি বুকের মধ্যে টনটন করছেঅবশ্য আজই প্রথম অভাবটি বোধ করেছে, তা নয়অভাবটি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছেএখনো জীবনের অনেক পথ বাকি বাবাকে সে ভীষণ ভালবাসেকিন্তু বাবা ছাড়া কিভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করবে, সেই ভাবনাটি ওকে কাঁদাচ্ছেবন্ধুদের মুখে যখন তাদের বাবার গল্প শোনে, তখন চোখে জল চেপে রাখতে কষ্ট হয় ওর

আত্মীয়-স্বজনরা যখন তাদের সন্তানদের আদর করেন, তখনো সে বুকের মাঝে কেমন বেদনা অনুভব করেশৈশবের একটি স্মৃতি আজ ওর ভীষণ মনে পড়ছেনিজেদের বাড়ির রান্নাঘরে ছুটে যাবার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল রান্নাঘরের দরজার খিড়কীতেকপালের বাঁ দিকে ফেটে গিয়ে ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুটেছিলবাবা অসুস্থ অবস্থায় ঘরে শুয়েছিলেনচিৎকার শুনে তিনি ছুটে এলেননিজের অসুস্থতার কথা ভুলে ওকে কোলে তুলে ছুটলেন ডাক্তারের কাছেগ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে তিনিও হাঁপিয়ে উঠেছিলেনবাবার এতটা পথ ছুটে যাওয়া ছিল ঝুঁকিপূর্ণসবাই রাশেদকে বকেছিলবলেছিল, “আর এমন দুষ্টুমি করবি? তোর দুষ্টুমির জন্য অসুস্থ বাবাও যে মরতে বাসেছিল!সেদিন বাবা ওর পক্ষ নিয়েছিলেনসবাইকে বলেছিলেন, “ওকে বকছো কেন? এতটুকুন বাচ্চা! ও তো দুষ্টুমি করবেইও কি বুঝেশুনে এসব করেছে?” জলভরা চোখে মেঘ ও চাঁদের দিকে তাকিয়ে আজ সেই স্নেহময়ী বাবার মুখখানা অস্পষ্ট হয়ে ভাসছেঅশ্রুভেজা ঝাপসা চোখদুটো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে ঝাপসা চোখকে পরিষ্কার করে বাবার মুখখানা স্পষ্ট করে দেখতে চাইছে ওনা, দেখতে পাচ্ছেনাওর চোখের বন্যা কিছুই স্পষ্ট হতে দিচ্ছেনাআজ পৃথিবীর প্রতিও ওর অভিমান হচ্ছেপৃথিবী কেন এত নির্দয় হল? কেন এত তাড়াতাড়ি ওর বাবাকে বিদায় দিল? ওরও এখন পৃথিবীর সাথে আড়ি দিয়ে বাবার কাছে চলে যেতে ইচ্ছা করছে

বাবার কত স্মৃতিই না আজ ওর মনে পড়ছেএকবার সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবা সারারাত ওর পাশে বসে সুস্থতার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করেছেন বাবার মৃত্যুর দিনটিও আজ চোখে ভাসছেবাবা মারা গিয়েছিলেন রাত ১০-১১ টার দিকেসেদিন বাবা নিজ হাতে ওকে ওজু করিয়েছিলেন

আজ বাবা নেই কিন্তু বাবাকে নিয়ে তখনকার যে স্মৃতিগুলো ওর ছোট্ট মগজে জমা হয়েছিল, সেগুলো মনে করে তার ছোট্ট মনটা যে হাহাকার করে, তা কি পৃথিবী কখনো বোঝে? বুঝলে নিশ্চয়ই বাবাকে ওর কাছ থেকে নিয়ে যেতনা

জান্নাতুল ফেরদৌস কোথায়! সে কি ওই সপ্ত আসমানের উর্দ্ধে! সেখানে কি অবিরাম সুখ বিরাজ করছে! সেখানে কি এমনি করে মেঘে চাঁদ ঢেকে দেয় না! বাবা তুমি সেই জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা হওতুমি অনন্ত সুখে থাকোহাত দুটি কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত ছুঁয়ে বাবার জন্য দোয়া করল রাশেদভেজা হাতের চিবুক স্পর্শে স্তম্ভিত ফিরে পেল সেহাত দুটি ভিজল কিসে? ওই আকাশের জলভরা মেঘে? নাকি ওর মনের আকাশে যে মেঘ জমেছিল, তার বৃষ্টিতে! পরম শ্রদ্ধায় হাত দুটিতে চুম্বন করল সে
 
 
 
~প্রজাপতি....প্রজাপতি~~

বাসের ছাদে বসে ভ্রমন করাটা অনেকেই কষ্টসাধ্য অথবা বিরক্তির চোখে দেখে ধ্রুবর কাছে এসব কোন ব্যাপার না বরং ছাদে বসে থাকতেই বেশি সাচ্ছ্যন্দ বোধ করে সে পৃথিবীর মুক্ত রূপটা তার সামনে উন্মুক্ত হয় গন্তব্য সর্ম্পকে তেমন একটা সচেতন হয়তো নয় সে সিগারেট খাবে ভাবলো ধ্রুব ভাল লাগছে না তার সিগারেট ধরালে হয়তো মন্দ হয় না পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোটে চেপে ধরলো সে লাইটারটা আনতে ভুলে গিয়েছে ধ্রুব তাই বাসে উঠার আগে ম্যাচ কিনে নিয়েছিল সে বাস এখন ঢাকা চট্ট্রোগ্রাম মহাসড়কের উপর দিয়ে চলছে সামনে কোথায় যেন একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে , তাই বর্তমানে বাসের বেগ কচ্ছপের বেগের সমানুপাতিক যদিও এখন বাস যে জায়গাটায় আছে সেখানে প্রচন্ড বাতাস ধ্রুব ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে হাত দিয়ে ঢাকতে চাইলো কিন্তু তার আগেই নিভে গেল কাঠিটা আরো কয়েকটা কাঠি জ্বালাতে গিয়েও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বিরক্ত হলো সে সিগারেটের উপর সমস্ত ঝাল ঝাড়তেই যেন সিগারেট টাকে দলা মোচড়া করে ছুড়ে ফেলতে গেলো হটাত্‍ কি মনে হতেই যেন হাতটা কনুয়ের সাথে ১৪৫ ডিগ্রি কোনে এসে থেমে গেলো ১২ বছর আগের একটা ঘটনা মনে পরে গেলো তার একরাতে বারান্দায় দাড়িয়ে চুপচাপ সিগারেট খাচ্ছিলো ধ্রুব হটাত্‍ করেই পিছন থেকে একটা কন্ঠ বলে উঠলো "ভাইয়া , তুই কি করছিস ?" চমকে উঠলো ধ্রুব হাতের সিগারেটটা দলা মোচড়া করতে গিয়ে হাত পুড়ে ফেলল কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই ধ্রুবর তার আতংকিত চোখ তখন স্থির হয়ে আছে নিশাতের দিকে নিশাত অগ্নিকন্ঠে বলল "কিরে কি করতেছিলি ?" জবাব দেয় না ধ্রুব । "দাড়া মা কে বলতেছি" বলেই ঘুড়তে গেলো নিশাত , এবার সক্রিয় হলো সে দৌড়ে গিয়ে নিশাতের হাত চেপে ধরে বলল "না না তুই যা চাইবি দিব তবুও মা কে বলিস না।" নিশাত যেন একটু ধাতস্থ হয় "সত্যি তো ?" জানতে চায় সে । "হ্যা হ্যা তিন সত্যি যা ।" দ্রুত উত্তর দেয় ধ্রুব । "আচ্ছা উমম. . . তাহলে আমাকে একটা ক্যাডবেরি কিনে দিবি আর অবশ্যই সিগারেট খাওয়া ছাড়বি" বলল নিশাত । "ইয়ে মানে সিগারেট ছাড়তে হবে ?" কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল ধ্রুব আবারও কঠিন দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায় নিশাত । "আচ্ছা আচ্ছা চোখ পাকাস কেন ? যাহ খাব না" বলে মুচকি হেসেছিল সে

ধ্রুবর হাত তালু জ্বলিয়ে সেদিন সিগারেটটা নিভে গিয়েছিল আর বোনের সাথে প্রতিজ্ঞার স্বারক রূপে সেই পোড়া দাগ এখনও রয়ে গিয়েছে ধ্রুবর হাতে মজার ব্যাপার হলো সিগারেটের প্যাকেট এখনও থাকে ধ্রুবর পকেটে প্যাকেট থেকে সিগারেটও বের হয় তবে তা আর ধ্রুবর খাওয়া হয় না বাসায় গেলে হয়তো রিমা বলে "সিগারেট খাও না , তো পকেটে নিয়ে ঘুড়ো কেন ?" ধ্রুব হাসে , সেই হাসির মাঝে মমতা মিশে থাকে হয়তো সিগারেট খায় না ধ্রুব কিন্তু সেদিনের ঘটনাটা পুনরায় চোখের সামনে বাস্তবতার রূপ নিয়ে হাজির হয় , যখন সে দুঠোটের মাঝে সিগারেট চেপে ধরে বাস তখন ভালই ছুটছে ধ্রুব যখন বাসের ছাদে উঠতে চেয়েছিল , বাসের হেল্পার ছেলেটা হা হা করতে করতে এসে বলেছিল "স্যার ছাদে কেন ? আপনেরে ভিত্রেই সিট দিতাছি আইয়েন ।" ধ্রুব মুচকি হেসে বলে "ছাদেই যাব ভিতরে বসলে দম বন্ধ হয়ে আসে ।" ছেলেটা মুখ কালো করে বলল "স্যার ভাড়া কিন্তু ২০০ ই কম হবে না ।" ধ্রুব হেসে ছেলেটার হাতে ২০০ টাকা গুজে দেয় তারপর বিস্মিত ছেলেটাকে নিচে রেখে বাসের পিছনে সিড়ি দিয়ে বাসের ছাদে উঠে আসে মনে পরে যায় যখন নিশাতকে নিয়ে স্কুলে যেত সে সব দিনের কথা একদিন রিকশাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছিল ধ্রুবর নিশাত ধ্রুবকেই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ১০ টাকার বদলে ১৫ টাকা ধরিয়ে দিল রিকশাওয়ালা হাসি মুখে চলে গেল ধ্রুব দাত খিচিয়ে বলেছিল "টাকা বেশি হয়ে গেছে তোর ?" "হ্যা হয়ে গেছে তারা খেটে খাওয়া মানুষ কয়েক টাকা বেশি দিলে কিছু হবে না বরং সোওয়াব পাবি ।" বলেছিল নিশাত ধ্রুব ছোট বোনের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল আপনমনেই হাসে ধ্রুব কতদিন পর বোনটাকে দেখতে যাচ্ছে সে ? হবে তো এই ৫-৬ বছর হ্যা অবশ্যই হবে বোনটা নিশ্টই খুব খুশি হবে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ক্যাডবেরি চকলেটার অস্তিত্ব অনুভব করলো ধ্রুব

আজকে ধ্রুবকে নস্টালজিয়া একদম আকড়ে ধরেছে ছোটবেলার কথা মনে পরে যায় বাবার অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না এই ছোট খাট ব্যাবসা করতেন দেখা যেত মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানাটানির মধ্যে চলতে হতো ধ্রুব তখন হাইস্কুলে সবে ভর্তি হয়েছে একটা মলিন শার্ট আর রং উঠা প্যান্ট পরে স্কুলে যেত স্কুলের সব ছেলে মেয়ে যখন টিফিন খেত , তখন সে হয়তো ক্যান্টিনের পাশে সাপ্লাইয়ের পানির ট্যাঙ্ক থেকে গলা পর্যন্ত পানি গিলতো প্রতিদিন ধ্রুবর টিফিনের জন্য বরাদ্দ টাকা ছিল মাত্র দুটাকা টাকাগুলো জমিয়ে রাখতো সে নিশাতের একটু ফাস্টফুড খাবারের প্রতি ঝোক ছিল দেখা যেত যখনই বাসায় বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত আসতো , তখনই নিশাত সেখাতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যেত কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য গিফট্ লাগে গিফটের জন্য লাগে টাকা তার সামর্থ্য ধ্রুবর বাবার ছিল অবুঝ বোনটার জন্য টাকা জমাতো ধ্রুব মাস শেষে বোনের জন্য পেস্ট্রি কেক অথবা কর্নিলা আইসক্রিম নিয়ে আসতো সে নিশাত মহা আনন্দে মুখে মাখিয়ে সেটা খেত ধ্রুব চুপচাপ হাসিমুখে ছোট বোনের খাওয়া দেখতো বোনটা হটাত্‍ই একদিন বড় হয়ে গেলো যেন ধ্রুব যখনই তাকে কিছু কিনে দিতে চায় তখন বলে "ভাইয়া ওসব খেলে পেট ব্যাথা করে ।" বোনটাকে বাস্তবতা বুঝতে দিতে চায়নি ধ্রুব কিন্তু পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর সবাইকেই বাস্তবতার মুখোমুখি করে ছাড়ে অতীত স্মৃতি মনে করে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ধ্রুবর বুক থেকে

একটা সময় ধ্রুবর খুব ইচ্ছা ছিল গান শিখার কিন্তু নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে এসব শখ যে বিলাসিতার নাম মাত্র তা খুব ভালভাবেই জানতো ধ্রুব মানুষের ইচ্ছা খুবই অদ্ভুত , যখন ইচ্ছে হয় তখন মানুষ আবেগটাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি , যুক্তিকে না তাই পাড়ার মোড়ে সিডির দোকানটার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতো সে দোকানের কাছে চলতে থাকা হাই ভলিউমের গানের সাথে গলা মেলাতে চাইতো নিশাত ছিল তার ভাইয়ের গানের ভক্ত ভাইকে জোর করে শিল্পকলা একাডেমিতে পাঠিয়েছিল একটা অনুষ্ঠানের জন্য রেজিস্ট্রেশনের জন্য টাকার অংকটা শুনে আর ভিতরে যাওয়ার সাহস হয়নি ধ্রুবর বিকালে বাসায় ফিরে যখন ছাদে বসে ছিল মুখ কালো করে নিশাত এসে বসল তার পাশে তারপর বলল "ভাইয়া চল একসাথে গাই প্রজাপতি গানটা ।" প্রথমে ধ্রুব গাইতে চায়নি কিন্তু নিশাতের চাপাচাপিতে গাওয়া শুরু করে "প্রজাপতি , প্রজাপতি. . কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা ।" একটা সময় মন ভাল হয়ে যায় ধ্রুবর নিশাতের বিয়ে হয় যেদিন একটা বারের জন্যও বোনের সামনে যায়নি ধ্রুব বোনকে বিদায় দিতে গিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়েছিল নিশাত ধ্রুবর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেছিল "ছিঃ ভাইয়া কাঁদিস কেন ? ছেলেদের কাঁদতে নেই ।" বোনটা হটাত্‍ই যেন খুব বড় হয়ে গিয়েছিল সেদিন

বাস তখন কুমিল্লার পদুয়ার বাজার এসে থেমেছে ধ্রুব বাস থেকে নামলো একটা সিএনজি ঠিক করে রওনা দিলো মূল কুমিল্লা শহরের দিকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বোনকে দেখতে আসছে সে সেই সাথে তার জন্মস্থানকেও পাঁচ বছর পর দেখছে অতীতের দিনগুলো মনে করতে করতে কখন যে সময় চলে গেলো বুঝলো না ধ্রুব বাস্তবে ফিরলো সিএনজি চালকের কথায় ধ্রুব দেখলো যে সামনেই নিশাতের শশুরবাড়ি বিশাল বনেদি পরিবার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো সে বিকাল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা , সব কিছুর লম্বা ছায়া পড়েছে সবখানে গেটের কাছাকাছি আসতেই নিশাতের হাজব্যান্ড রাফসানের সাথে দেখা হয়ে যায় ধ্রুব হাসিমুখে এগিয়ে আসে রাফসান । "ভাইয়া কেমন আছেন ? কতদিন পর এসেছেন !" মৃদু হাসে ধ্রুব , উত্তর দেয় না তারপর অস্ফুট কন্ঠে বলে "রাফসান নিশাতকে দেখতে এসেছি ।" মুখের হাসিটা মুছে যায় রাফসানের , নির্লিপ্ত মুখে মাথা ঝাকায় সে তারপর রাস্তা ধরে হাটতে থাকে , ইশারা করে ধ্রুবকে ধ্রুব সবে পা বাড়িয়েছে এমন সময় ছোট্ট একটা মেয়ে দৌড়ে এসে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে ধ্রুব মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয় ছোট্ট মেয়েটা আদুরে গলায় বলে "মামা" রাফসান এগিয়ে আসে , মুচকি হেসে বলে "নিশাত আপনার এতো ছবি ঘরে রেখেছে যে নিহার আপনাকে একবার দেখেই চিনে ফেলেছে ।" ধ্রুব হাসে । "মামা , আমার জন্য কি এনেছো ?" নিহার প্রশ্ন করে ধ্রুব আবারো একটু মুচকি হাসে পকেট থেকে ক্যাডবেরি চকলেট বের করে দেয় ভাগনিকে নিহার মহা খুশি হয়ে চকলেটটা ধরে , তারপর টুক করে ধ্রুবর গালে চুমো বসিয়ে দেয় একটা ধ্রুব নিহারকে কোল থেকে নামায় , মহা আনন্দে ক্যাডবেরি নিয়ে বাসার ভিতরে দৌড় দেয় সে ধ্রুব তখনও মুখে স্নেহের হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ভাগনির দিকে ঠিক যেন নিশাতের কার্বন কপি রাফসান এতোক্ষন চুপচাপ ছিল নিহার চলে যাওয়ার পর ইশারা করলো ধ্রুবকে , তারপর হাটতে লাগলো ধ্রুব অনুসরন করলো তাকে

নিশাতের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল রাফসান জায়গাটার চারিদিকে দুই ফুট উচু বাউন্ডারি দেয়া ঠিক পাশেই বিশাল এক আম গাছ ঘরটাকে ছায়া দিচ্ছে বাউন্ডারির কাছে গিয়ে বসে ধ্রুব তার বোনটা ঘুমাচ্ছে মাত্র সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে উচ্চাভিলাষ জিনিসটা নিশাতের ছিল না , তাই হয়তো মাটির ঘরেই সুখে আছে সে ধ্রুব মাটির উপর হাত ছোঁয়ায় তারপর খুব আস্তে হাত বুলায় মাটির উপর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার ব্যাবসায়িক কাজে দেশের বাইরে গিয়েছিল ধ্রুব নিশাত তখন আট মাসের অন্তঃস্বত্তা বোনের কনসিভের খবর শুনে দ্রুত বাংলাদেশে ছুটে আসে সে এসে দেখে তার পুতুল বোনটা আরেকটা পুতুলের জন্ম দিয়েছে কিন্তু বোনকে দেখতে পায় না নিশাতকে আইসিইউ তে রাখা হয়েছে দুই দিন টানা হাসপাতালে ছিল ধ্রুব হাজার বার ডাক্তারকে বোনের অবস্থা জিজ্ঞেস করেছে বোনকে দেখতে চেয়েছে কিন্তু ডাক্তার তাকে কিছুই বলেনি তৃতীয় দিন সন্ধ্যার দিকে ডাক্তার ধ্রুবকে আইসিইউতে নিয়ে যায় ধ্রুব ঢুকে দেখে নিশাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মলিন হয়ে আছে মায়াময় মুখটা ধ্রুব নিশাতের কাছে গিয়ে বসে নিশাত চোখ খুলে তাকায় মৃদু হাসে হয়তো তারপর খুব আস্তে আস্তে বলে "ভাইয়া গান শুনতে ইচ্ছা করছে রে , গানটা শোনাবি ?" ধ্রুব কিছু বলে না , নিশাতের ডান হাতটা চেপে ধরে গাইতে থাকে

"প্রজাপতি , প্রজাপতি. . কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা ।"
নিশাতের হাত নিঃস্পন্দ হয়ে যায় একটা সময় , ধ্রুব তবুও গেয়ে যায় অশ্রুভরা চোখে বোনের হাত শক্ত করে ধরে রাখে ডাক্তার এসে ধ্রুবকে সরিয়ে নিতে চায় কিন্তু ধ্রুব সরে না বোনের কপালে হাত বুলাতে থাকে সেদিন ভয়াবহ রকমের কষ্ট হচ্ছিলো ধ্রুবর যেমনটা আজকে হচ্ছে কবরটার মাথার দিকের মাটিতে হাত বুলাতে থাকে সে খুব আস্তে . . যেন একটু জোড়ে হাত বুলালেই বোনটা জেগে যাবে ছোট বেলায় যেভাবে বোনকে ঘুম পাড়াতো ধ্রুব , ঠিক সেভাবে টপটপ করে চোখের পানি ঝড়তে থাকে ধ্রুবর । "ছিঃ মামা কাঁদছো কেনো ?" আদুরে একটা গলা বলে উঠে নিহার এসে দাড়িয়েছে পাশে পাঁচ বছরের ছোট্ট ভাগনির মাঝে বোনকে খুঁজে ফেরে ধ্রুব সন্ধ্যা নেমেছে তখন আকাশের মাঝে জোছনার মায়াবি আলোর ছটা পৃথিবীকেও সিক্ত করেছে ধ্রুব ছোট বাচ্চার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ভাগনির দিকে । "মামা গান শুনবে ?" জিজ্ঞেস করে নিহার ঘাড় কাত করে ধ্রুব । "আচ্ছা" বলে মুচকি হাসে নিহার তারপর একদম মায়ের মতই গাইতে থাকে "প্রজাপতি , প্রজাপতি. . কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা ।"

অন্ধকার পৃথিবীর মাঝে তখন জোছনার আধিপত্য দেখা যায় ঝিঝিরা আজ ডাকতে ভুলে গিয়েছে যেন পৃথিবীতে শুধু নিহারের গান ব্যাতিত কোন শব্দ অবশিষ্ঠ নেই টপ টপ করে ধ্রুব চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে তার মনে হয় যেন নিশাত এখনই এসে বলবে "গান তো শুনলি , এখন বল কি দিবি ?" । "মামা তুমি কাদঁছো ?" নিহারের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে ধ্রুব নিহারের দিকে তাকায় পাঁচ বছরের ছোট ভাগনির মাঝে নিজের ছোট বোনকে খুঁজে পায় নিহার তার ছোট ছোট হাত দিয়ে ধ্রুবর চোখের পানি মুছে দেয় ধ্রুব ম্লান হাসে নিহারকে কোলে তুলে নেয় সে হাটতে থাকে জোছনাস্নাত রাজপথ ধরে আকাশের পটভূমিতে একটি তারার উজ্জ্বলতা বেড়ে যায় জোছনার আলো যেনো আরেকটু বেশি গাঢ় হয় ধ্রুব তখন নিহারকে কোলে নিয়ে হেটে চলেছে ছোট্ট নিহার মামার গালে টুক করে একটা চুমু দেয় ধ্রুব নিহারের দিকে ফিরে আবারও একটু হাসে প্রতিবার নিহারের মাঝেই নিশাতকে খুঁজে ফেরে পৃথিবীর অব্যাক্ত কথার খাতায় আরেকটা লাইন লেখা হয়ে যায় হটাত্‍ ধ্রুব দেখতে পায় একটা প্রজাপতি উড়ছে জোছনার আলোয় প্রজাপতির রঙ্গিন রূপটা যেনো হারিয়ে যাচ্ছে ধ্রুবর মনে হয় নিশাতই যেন প্রজাপতি হয়ে উড়ছে রঙ্গিন পৃথিবী থেকে সাদা কালো পৃথিবীর মাঝে ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে সে ভয়াবহ রকমের কষ্ট হয় ধ্রুবর নিহারকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে , তারপর অস্ফুট কন্ঠে খুব আস্তে আস্তে গাইতে থাকে

"প্রজাপতি , প্রজাপতি. . কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা ।"

উত্‍সর্গঃ

আমার কলিজার টুকরা দুটো বোন নিধি , নিঝুকে কাল রাতে ভয়াবহ কষ্টের মাঝে এক বসায় লেখা অনেক অব্যাক্ত কথা ভাষা পেয়েছে হয়তো লেখার মাঝে নিধিকে জন্মদিনে একটা ক্যাডবেরি কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ভাই আমি আমার কখনো ইচ্ছা হয়নি কোথাও লেখা ছাপাতে কখনো ইচ্ছা হয়নি আমি আমার পরিবারকে লেখা দেখাতে আজ খুব ইচ্ছা হচ্ছে কেন যেনো খুব বেশি ইচ্ছা হচ্ছে ইচ্ছে হচ্ছে বুকের ভিতর জমাট বাধা কষ্টগুলোকে সারা পৃথিবীর সবখানে ছড়িয়ে দিতে . .
Share:

Related Posts:

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.

Fiverr Offer

Popular Posts

Powered by Blogger.

Labels

Labels

Popular Posts

Labels

Blog Archive