"দাদু....! ও দাদু....!" গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে রাফসান। "আজকে গল্প বলবা না?"
এটা ওদের দু'ভাই বোনের নিত্যকার ঘটনা। ৯:৩০ বাজলেই পড়ালেখা মাচায় তুলে দাদুর কাছে
গল্প শুনতে বসে তুলি আর রাফসান। তুলি সদ্য নাইনে উঠল আর রাফসান ইংলিশ মিডিয়ামে ফিফথ স্ট্যান্ডার্ডে পড়ে।
...
-"উফফ্! রোজ রোজ এত গল্প পাই কোথায়?" নাতী-নাতনীর তাড়ায় তসবীহ গোনা বন্ধ করেন রাজিয়া বেগম।-না, বলতেই হবে। যা খুশি তাই বল। তোমাকে বলতেই হবে।"
রাফসানের জোরাজুরি'তে গল্প খুঁজে ফেরেন রাজিয়া বেগম। তুলি হঠাৎ বলে,"আজ দাদাজানের গল্প শুনব।"
স্বামীর কথায় মাথায় কাপড় তোলেন রাজিয়া। বলেন,"তোদের দাদার আবার গল্প কীরে?"
-এই তোমাদের কীভাবে বিয়ে হল। তারপর কী হল...এসব।"
মুচকি হেসে বলতে শুরু করেন দাদু। "তোরা শুনলে অবাক হবি তোদের দাদার সাথে আমার পরিচয় বিয়ের আগে থেকেই ছিল। উনি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াতেন। আর আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার বাবা শিক্ষিত হওয়ায় আমি পড়া চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার পথে উনার সাথে দেখা হত। লজ্জায় কোন কথা বলতাম না।
-তুলি আর রাফসান একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে।
একদিন সকালে রহিম চাচা আমাদের বাড়ি এলেন তোর দাদার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি পাশের ঘর থেকে শুনে লজ্জা আর খুশিতে লাল হয়ে গেলাম। বাবা বিয়েতে মত দিলেন ও। তবে, এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে উনি সন্কোচ করছিলেন।
মাকে বললেন আমার মত নিতে। মা আমাকে রাতে জিজ্ঞাসা করলেন,"কীরে, বিয়ে করবি হাসান মাস্টারকে?" আমি অভিনয় করে বললাম,"না"! কিন্তু, মা ঠিকই বুঝে ফেললেন। আর বাবাকে বললেন আমি রাজী।
এক মাস পরে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। তারপর, সুখে আর হাসিতে কেটে গেল বছরখানেক। সারাদিন আমাকে জ্বালাতেন তোদের দাদা। গোসল সেরে আসলে আমি যখন শাড়ি মেলতাম। আয়নার আলো ফেলতেন আমার মুখে। কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে আমি দৌড়ে ঘরে পালাতাম।
একাত্তরের মাঝামাঝিতে। দেশে যুদ্ধ দানা বেঁধেছে। তখন তোদের বাবা পেটে। উনি রাতে শুয়ে ছিলেন। আমি পাশে শুতেই বললেন,"রাজিয়া, ভাবছি যুদ্ধে যাব।"
অজানা শংকায় কেঁপে উঠল আমার বুক। উনার হাত শক্ত করে ধরে বললাম," নাহ্! কখনো না !" কিন্তু তিনি শুনবেনই না। বাবা মাকে না জানানোর জন্য আমাকে তোদের বাবার কসম দিলেন। আমি কেঁদে আকুল হলাম। বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
একদিন ভোররাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে আমি জোরে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি আমার গাল ও মাথায় হাত বুলিয়ে ওই ভোরের আলোয় চলে গেলেন। আমি উঠোনের বেড়া ধরে তার চলে যাওয়া দেখলাম.....
মাস'দুয়েক কেটে গেল তার অপেক্ষায়। একদিন রাতে আমি অনেকক্ষণ জেগে জেগে ঘুমিয়ে পড়লাম। অমনি তার গলা শুনে আমি ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। উনি ঘরে এসে বললেন কিছু খেতে দিতে। অতরাতে খাবার কিছু ছিল না। রান্নাও করতে দিলেন না। চিড়ে আর মুড়ি খেয়ে আমার শরীর-স্বাস্থ্য আর সবার কুশল জিজ্ঞাসা করে চলে গেলেন। বললেন ইন্ডিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে এখন যুদ্ধ করবেন। আমি সুরা পড়ে উনার বুকে ফুঁ দিয়ে দিলাম।
দিন সাতেক পরে তোদের বাবা হল। তোদের বাবার বয়স যখন তিন মাস। দেশ স্বাধীনের কয়েকদিন বাকি তখনো.......
এমন একদিন দুপুরে পাশের গাঁয়ের মতি মিয়া দৌড়ে আসল। এসে বাবাকে কী'জানি বলল। মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।
পরে শুনেছি সম্মুখ সমরে নিজের আহত সাথীকে বাঁচাতে গিয়ে উনি পাকবাহিনী'র হাতে ধরা পড়েন। আজও তাঁর কোন খোঁজ পাইনি...
আঁচলে চোখ মোছেন রাজিয়া বেগম। রাফসান আর তুলিও কাঁদতে থাকে তাঁকে জড়িয়ে ধরে.....
No comments:
Post a Comment
Note: only a member of this blog may post a comment.